
আনজর আল মুনির | ডেইলি জকিগঞ্জ | ২৭ অক্টোবর ২০২৫
২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর—বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি কলঙ্কময় ও নির্মম দিন। সেদিন ঢাকার পল্টন ময়দানে সংঘটিত লগি-বৈঠার সেই রক্তাক্ত তাণ্ডব এখনো জাতির বিবেককে নাড়া দেয়। প্রকাশ্য দিবালোকে লগি-বৈঠা, লাঠি ও আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের নিরস্ত্র নেতাকর্মীদের ওপর যে নির্মম হামলা চালানো হয়, তা ইতিহাসে নজিরবিহীন।
ভয়াবহ সেই দিন:
সেদিন বিকালে বায়তুল মোকাররমের উত্তর সড়কে জামায়াতে ইসলামী ঢাকামহানগরের উদ্যোগে এক শান্তিপূর্ণ সমাবেশের প্রস্তুতি চলছিল। সকাল থেকেই মঞ্চ তৈরির কাজ চললেও সকাল ১১টার দিকে আকস্মিকভাবে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের কর্মীরা লগি-বৈঠা ও অস্ত্র নিয়ে হামলা চালায়। শুরু হয় নৃশংস পিটুনি, গুলিবর্ষণ, বোমা হামলা। মুহূর্তের মধ্যেই সমাবেশ এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়।
দৃশ্য ছিল বিভীষিকাময় — মাটিতে লুটিয়ে থাকা মানুষদের ওপর বৃষ্টির মতো আঘাত, মৃতদেহের ওপর উল্লাস, এবং পুলিশ দাঁড়িয়ে থাকা নির্বিকার দর্শক হিসেবে। এই নারকীয় হামলায় শহীদ হন অন্তত ৬ জন জামায়াত-শিবির কর্মী, আহত হন শতাধিক। তাদের মধ্যে ছিলেন শিবির নেতা মুজাহিদুল ইসলাম, কর্মী হাবিবুর রহমান ও জসিম উদ্দিন প্রমুখ।
সুপরিকল্পিত হামলা:
বিভিন্ন সাক্ষ্য, ভিডিও ফুটেজ ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণে জানা যায়—এ হামলা ছিল সম্পূর্ণ পরিকল্পিত। আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারা অস্ত্রধারী বাহিনী নিয়ে সমাবেশ স্থলে ঢুকে পড়ে। আশপাশের ভবনের ছাদে বোমা ও আগ্নেয়াস্ত্রসহ অবস্থান নেয় তাদের কর্মীরা। পল্টনের প্রতিটি গলি থেকে নিরীহ মানুষদের টেনে এনে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। নিহতদের মধ্যে কেউ কেউ মৃত্যুর পরও নির্মমভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হন।
সিলেটে আওয়ামী সন্ত্রাসীদের হামলা:
রাজধানী ঢাকা ছাড়াও একই ধরণের হামলা চালানো হয় দেশের বিভিন্ন স্থানে জামায়াতের কর্মসূচিগুলোর ওপর। সিলেটের কোর্ট পয়েন্টে সমাবেশের আগ মুহূর্তে অতর্কিত হামলার শিকার হন তৎকালীন সিলেট মহানগর শিবির সভাপতি ও বর্তমান মহানগর জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি নুরুল ইসলাম বাবুল, শিবির নেতা মনজুর রহমানসহ আরও অনেকে। হামলাকারীদের নির্মম আঘাতে নুরুল ইসলাম বাবুল মাটিতে লুটিয়ে পড়েন—তার মাথার খুলি ভেঙে যায় ছয় টুকরোতে। সহকর্মীরা নিজেদের শরীর দিয়ে তাকে ঢেকে নিরাপদে সরিয়ে আনেন। পরে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে তাকে ঢাকায় নেওয়া হয় চিকিৎসার জন্য। দীর্ঘ সময়ের চিকিৎসার পর তিনি বেঁচে ফিরলেও আর পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে পারেননি। একসময় যিনি ছিলেন অনলবর্ষী বক্তা, আজ কথা বলতে গেলেই তার জিহ্বা কেঁপে ওঠে, বাক্য জড়িয়ে যায়।
পুলিশের নীরবতা ও বিতর্কিত ভূমিকা:
পুরো ঘটনার সময় পুলিশ বাহিনী নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে। হামলাকারীরা প্রকাশ্যে অস্ত্র ব্যবহার করলেও কোনো বাধা দেয়নি পুলিশ। এমনকি আহতদের উদ্ধার করতেও উদ্যোগ নেয়নি। তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে।
মামলার শুরু ও পরিণতি:
ঘটনার পরদিন জামায়াতে ইসলামী পল্টন থানায় মামলা করে, যেখানে আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলের প্রায় ৪০ জন নেতার নাম উল্লেখ করা হয়। ২০০৭ সালে আদালতে চার্জশিট দাখিল হয়, এমনকি শেখ হাসিনাসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানাও জারি হয়। কিন্তু পরবর্তীতে “অধিকতর তদন্ত” ও রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের অজুহাতে মামলা স্থগিত হয়ে যায়।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে এই মামলাসহ নিজেদের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা অনেক মামলা প্রত্যাহার করে নেয়। ফলে ভয়াবহ এই হত্যাকাণ্ডের বিচার আজও হয়নি।
শহীদ পরিবারগুলোর ক্ষোভ ও আশা:
বিচার না হওয়ায় শহীদ পরিবারগুলো ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। শহীদ মাসুমের মা শামসুন্নাহার রুবি বলেন, “কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়। তবে সরকার নিজ দলের সন্ত্রাসীদের রক্ষা করছে। তবুও আমি আশা ছাড়িনি—একদিন বিচার হবেই।”
শহীদ জসিমের স্ত্রী নারগিস আক্তার বলেন, “জালেম কখনো বিচার করতে পারে না। তবে এই অন্যায়ের বিচার একদিন হবেই।”
ইতিহাসের শিক্ষা:
২৮ অক্টোবরের লগি-বৈঠার তাণ্ডব শুধু কয়েকজন মানুষের মৃত্যু নয়—এটি বাংলাদেশের গণতন্ত্র, মানবতা ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির ওপর এক গভীর আঘাত। সেই ঘটনার বিচার না হওয়ায় আজও রাজপথে সহিংসতার পুনরাবৃত্তি দেখা যায়।
জাতির স্বার্থেই প্রয়োজন — এই ঘটনার পূর্ণ তদন্ত, দায়ীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি এবং ভবিষ্যতের রাজনীতিতে সহিংসতার অবসান।
২৮ অক্টোবর তাই আজও একটি স্মরণীয় ও রক্তাক্ত দিন, যা আমাদের মনে করিয়ে দেয় — রাজনৈতিক প্রতিহিংসা কতটা ভয়াবহ হতে পারে এবং বিচারহীনতা কত বড় অভিশাপ বয়ে আনে।
লগি-বৈঠার তান্ডব ও হাসিনার ফ্যাসিবাদ:
২৮ অক্টোবরের এই ভয়াবহ হামলা ছিল কেবল শুরু। এর পর থেকেই দেশের রাজনীতিতে দমন-পীড়ন, গ্রেপ্তার, গুম ও রাজনৈতিক নিপীড়নের এক অন্ধকার অধ্যায় শুরু হয়। সরকারের পক্ষ থেকে বিরোধী মতকে দমন করার ধারাবাহিক প্রচেষ্টা বাড়তে থাকে।বিডিআর হত্যা, আল্লামা সাঈদীর রায়ের দিনে গণহত্যা, শাপলা চত্বরে মুসলিম নিধন,মোদি বিরোধী আন্দোলনে গণহত্যা, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হত্যা,গুম, শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিগুলোর ওপর নির্বিচারে গুলি,হামলা, সমাবেশ ভেঙে দেওয়া, বিরোধী নেতাকর্মীদের ওপর সীমাহীন নির্যাতন এবং সর্বশেষ জুলাই ২০২৪ এ ঢাকায় শিশু ও শিক্ষার্থী গণহত্যা— সবকিছুর মূলে কাজ করে ২৮ অক্টোবরে মানুষ হত্যার পৈশাচিক চেতনা।সেদিন থেকে শুরু হয়ে জুলাই বিপ্লব পর্যন্ত হত্যাযজ্ঞের ক্ষোভের বিস্ফোরণে ঘটে হাসিনার পতন।হাসিনা ও আওয়ামীলীগের সকল অপকর্মের বিচারের সাথে ২৮ অক্টোবর লগি-বৈঠার তান্ডবের বিচারে হাসিনা ও সংশ্লিষ্ট আওয়ামীলীগ নেতাদের সর্বোচ্চ শাস্তি হোক এটাই জাতির প্রত্যাশা।

