লিখেছেন নির্বাহী সম্পাদক আনজর আল-মুনির

জকিগঞ্জে অনলাইন জুয়ার ভয়াবহ বিস্তার: সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব

Daily Daily

Zakiganj

প্রকাশিত: ১১:৩৭ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ৫, ২০২৫

হাতে হাতে স্মার্ট ফোন ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে অনলাইন জুয়া/বাজি /গেম আমাদের জকিগঞ্জে মাদকের চেয়েও ভয়ানক আকার ধারণ করেছে। মহামারীর মত ছড়িয়ে পড়ছে সামাজিক অবক্ষয়। স্মার্টফোনে মাত্র কয়েকটি ক্লিকের মাধ্যমে এখন কিশোর, তরুণ ও যুবকরা অনলাইন জুয়ার ফাঁদে জড়িয়ে পড়ছে। বিদেশি এসব অ্যাপ খুব চতুরভাবে প্রথমে সেলিব্রিটিদের মাধ্যমে সামান্য লাভ দেখায়, এরপর বড় মুনাফার লোভ দেখিয়ে ক্রমে নিঃস্ব করে ফেলে।

জকিগঞ্জের প্রায় প্রতিটি গ্রামে এই ভয়াবহ প্রবণতা ছড়িয়ে পড়েছে। অনেল শ্রমজীবী মানুষ সারাদিনের কষ্টার্জিত টাকা জুয়ার অ্যাকাউন্টে ঢেলে দিচ্ছেন। অনেকেই সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ছেন, কেউ কেউ ধার -দেনা করতে করতে সবশেষে ঘরের জিনিসপত্র ও সম্পত্তি বিক্রি পর্যন্ত করছেন। অনলাইন জুয়ার টাকা নিয়ে মারামারি ও আইন-শৃঙ্খলা অবনতি ঘটানোর অনেক ঘটনা জকিগঞ্জে নিয়মিত ঘটছে।অনেক শ্রমজীবী মানুষ সামান্য টাকা আয় করে নিত্য দিনের বাজার সদাই না করে জুয়ায় টাকা খোয়াচ্ছেন,এতে পারিবারিক শান্তি-শৃঙ্খলার অবনতি হচ্ছে। চায়ের দোকান, স্থানীয় ক্লাব কিংবা বাজারের আড্ডায় এখন প্রকাশ্যে এসব বাজির আলোচনা চলছে। তরুণরা মোবাইল হাতে গোপনে নয়, বরং প্রকাশ্যেই বাজি ধরছেন। এর ফলে কেবল ব্যক্তিগত ক্ষতি নয়, পুরো সমাজের মধ্যে নৈতিক অবক্ষয়ের ঢেউ ছড়িয়ে পড়ছে।

সবচেয়ে ভয়াবহ দিক হলো—দেশব্যাপী এই জুয়ার টাকা আসলে চলে যাচ্ছে দেশের বাইরে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমছে, ডলারের দাম বাড়ছে, আর মুদ্রাস্ফীতি বাড়িয়ে দিচ্ছে মানুষের দৈনন্দিন জীবনের ব্যয়ভার। হিসাব করলে দেখা যায়, শুধু উপজেলা পর্যায় থেকেই প্রতিদিন কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার হচ্ছে, বছরে যা দাঁড়ায় হাজার হাজার কোটি টাকায়। এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে, যা শেষমেষ ভোগ করছে সাধারণ মানুষ।

এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে হলে একযোগে সমাজ ও রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে। প্রথমত, আলেম সমাজ ও ইমামগণ খুতবা ও ওয়াজ মাহফিলে মানুষকে সচেতন করতে পারেন, জুয়ার ভয়াবহতা ও ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এর নিষিদ্ধ দিকগুলো তুলে ধরতে পারেন। দ্বিতীয়ত, অভিভাবকদের দায়িত্ব হলো সন্তানের মোবাইল ব্যবহার নিয়মিত খেয়াল রাখা, তাদের সময় কাটানোর বিকল্প ইতিবাচক পরিবেশ তৈরি করা। তৃতীয়ত, রাজনৈতিক নেতা ও জনপ্রতিনিধিদের উচিত প্রশাসনিকভাবে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণে ভূমিকা রাখা, স্থানীয়ভাবে এসব জুয়ার আড্ডা বন্ধ করা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কার্যকর ভূমিকা রাখতে উৎসাহিত করা। একইসাথে সচেতন মহল জনমত গড়ে তোলে এবং সামাজিকভাবে এ ধরনের বাজি খেলার বিরোধিতা করতে পারেন।

ভয়ানক এই সমস্যা সমাধানে প্রথমত রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে অনলাইন জুয়ার সব প্ল্যাটফর্ম শক্ত হাতে বন্ধ করা জরুরি। দ্বিতীয়ত, সন্দেহজনক আর্থিক লেনদেন চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে হবে। তৃতীয়ত, স্থানীয়ভাবে চায়ের দোকান ও ক্লাবে বাজি খেলা চললে সেগুলো বন্ধে প্রশাসনিক অভিযান পরিচালনা করতে হবে। পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদে খেলাধুলা, ইসলামি সাংস্কৃতিক কার্যক্রম ও বিনোদনের ইতিবাচক বিকল্প বাড়াতে হবে, যাতে তরুণ প্রজন্ম বিপথে না যায়।

সবচেয়ে বড় দায়িত্ব হলো—সচেতনতা তৈরি। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র একসাথে এগিয়ে এলে তবেই জকিগঞ্জসহ সারাদেশকে অনলাইন জুয়ার এই ভয়াবহ ফাঁদ থেকে রক্ষা করা সম্ভব। এতে যেমন মানুষের জীবন স্বাভাবিক হবে, তেমনি এলাকার অর্থনীতি শক্তিশালী হবে।

লেখক – আনজর আল মুনির, নির্বাহী সম্পাদক, ডেইলি জকিগঞ্জ